কাজী নজরুল ইসলামকে জানতে হলে অষ্টাদশ শতাব্দী ও উনবিংশ শতাব্দীর ভারতবর্ষের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা সম্পর্কে জানা থাকতে হবে। সেকালে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অবস্থা কেমন ছিল সে সম্পর্কেও ধারণা থাকতে হবে। বিশেষ করে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার করুণ পরিণতি থেকে শুরু করে ভারতে ইংরেজ শাসনের নানান উপাচার উৎপীড়ন সম্পর্কে অবশ্যই চর্চা থাকতে হবে।
ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষে তাদের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড সূচারু রূপে পরিচালনা করার জন্য ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজিকে রাজভাষা ঘোষণা করে। তারা যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে। ১৮৫১-৫২ খ্রিস্টাব্দে রেলপথ স্থাপন, ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে টেলিগ্রাফ প্রবর্তন করে। ইংরেজ সরকার তাদের শাসন ব্যবস্থা চালু রাখার প্রয়োজনে এদেশে স্কুল কলেজ মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে।
ফলে বঙ্গদেশের মানুষের মনে সামাজিক, রাজনৈতিক ও আধুনিক চিন্তা-চেতনা সঞ্চারিত হয়। তারই ফল এদেশে স্বাজাত্যবোধের বিকাশ ও রাজনৈতিক আন্দোলন। ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে বাঙালিরা পরিচিত হয় পাশ্চাত্য সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানের সঙ্গে। এরই প্রভাবে গড়ে ওঠে আধুনিক বাংলা সাহিত্য। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় গদ্য রচনার সূচনা হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পাঠ্য-পুস্তক রচনার মধ্য দিয়ে। এর পূর্ণতা লাভ করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বঙ্কিমচন্দ্রের হাত ধরে। হিন্দু কলেজের ছাত্ররা বাংলা সাহিত্যে নতুন ধারার প্রবর্ত্তন করে। এই কলেজের ছাত্র মধুসুদন দত্ত রচনা করেন আধুনিক নাটক শর্মিষ্ঠা (১৮৫৯), আধুনিক মহাকাব্য মেঘনাদবধ (১৮৬১)। বঙ্কিমচন্দ্র গড়ে তুলেন আধুনিক উপন্যাসের ধারা। ‘রাণী চৌধুরাণী’ বঙ্কিমচন্দ্রের একটি সার্থক উপন্যাস। উনবিংশ শতাব্দীতে রবীন্দ্রনাথের হাতে বাংলা গীতিকবিতা সার্থক রূপ লাভ করে । সোনার তরী ও গীতাঞ্জলি রবীন্দ্রনাথের দুটি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ।
উনবিংশ শতকের এই নবজাগরণে মুসলমানদের মাঝে উল্লেখযোগ্য মুসলিম ব্যক্তিত্ব ছিলেন খান বাহাদুর নবাব আব্দুল লতিফ ও সৈয়দ আমীর আলী। এসময় সাহিত্যক্ষেত্রে মীর মোশাররফ হোসেন ও কায়কোবাদ বিশেষ অবদান রাখেন। মীর মোশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’ (১৮৮৫) সেকালে বাংলার ঘরে ঘরে পঠিত হতো। মীর মোশাররফ হোসেনের নাটক ‘জমিদার দর্পণ’ও (১৮৮৫) সর্বত্র সাড়া জাগায়। সেকালে কায়কোবাদের মহাকাব্য ‘মহাশ্মশান’ও যথেষ্ঠ সমাদৃত হয়েছিল।
তবে যে সকল বাঙালি মনীষীর অনন্যসাধারণ প্রতিভা ও কর্মনৈপুন্যে এবং সৃজনশীলতায় বাঙালি সভ্যতার নব-চেতনা চিৎপ্রকর্ষ আধুনিক রূপ পরিগ্রহ করেÑ তাঁদের মাঝে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অবদান বাংলা সাহিত্যে নতুন মাত্রা যোগ করে। নজরুলকে বিদ্রোহী কবি, সাম্যের কবি, জাগরণের কবি, মানুষের কবি, প্রেমের কবি, স্বাধীনতার কবি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এরপরও কবির আরো একটি পরিচয় রয়েছে। সেটা হলোÑ তিনি সম্প্রীতির কবি তথা বিশ্ব মানবতার কবি।
ভারতবর্ষের অবিভক্ত বাংলায় কাজী নজরুল ইসলাম এমন এক সময়ে (১৮৯৯) জন্মগ্রহণ করেছিলেন যখন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন জোরদার হচ্ছিল। ক্ষুধা দারিদ্র্য আর অসহায়ত্বের মাঝে ছিল কবির বসবাস। মক্তবে লেখাপড়া করা অবস্থায় তিনি মসজিদে আজান দিতেন। মাজার পরিচর্যা করতেন। তিনি ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে মক্তব পাঠ শেষ করেন। ১৯১০-১২ খ্রিস্টাব্দে লেটোর দলে যোগ দেন এবং কয়েকটি পালাগান রচনা করেন। তিনি ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে আসানসোলে রুটির দোকানে চাকুরি নেন। সে সময় আসানসোলের দারোগা রফিজুল্লাহ নজরুলকে ময়মনসিংহের ত্রিশালে তাঁর নিজ গ্রাম কাজীর শিমলায় নিয়ে যান। তিনি নজরুলকে দরিরামপুর হাইস্কুলে ভর্তি করে দেন। মেধাবী নজরুল ১৯১৩-১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দরিরামপুর হাইস্কুলে ৭ম ও ৮ম শ্রেণিতে লেখাপড়া করেন। এরপর নজরুল ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমান ফিরে গিয়ে রাণীগঞ্জের শিয়ারশোল রাজ হাইস্কুলে ভর্তি হন। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে দশম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় বেজে ওঠে বিশ্বযুদ্ধের দামামা। তিনি সেনাবাহিনীতে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক হিসেবে যোগদান করেন। সৈনিক অবস্থায় তিনি প্রথম বিশ^যুদ্ধে অংশ নিয়ে দেখেছেন যুদ্ধের ভয়াবহতা। গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন ঔপনিবেশিক শোষণ ও নিপীড়ন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙ্গে দেওয়া হলে তিনি ফিরে আসেন কোলকাতায়।
নজরুল হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান- এই চার ধর্মের মানুষের সঙ্গেই বসবাস করেছেন। তখন প্রতিটি ধর্মের রীতিনীতি আচার-অনুষ্ঠান ভিন্ন ভিন্ন হওয়ায় এবং এক ধর্মের মানুষের সাথে আরেক ধর্মের মানুষের পারিবারিক ও সামাজিক যোগসূত্র না থাকার বিষয়গুলো নজরুলকে গভীরভাবে ব্যথিত করতো। বর্ণবৈষম্য, গোত্র বৈষম্য, শ্রেণি বৈষম্য সাম্প্রদায়িক বিরোধ এবং সারল্য দৃষ্টিভঙ্গি ও পরমত সহিষ্ণুতার অভাবের কারণে ভারতবর্ষের সকল শ্রেণি পেশার মানুষের মধ্যে সাম্য ও সম্প্রীতির তীব্র সঙ্কট ছিল। ফলে সম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগেই থাকতো। এছাড়াও সমাজে ছিল প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা তথা অন্ধ বিশ্বাস, নিষ্ঠুর আচরণ, জঘন্য তন্ত্র-মন্ত্র ও পাশবিক কুসংস্কার। সতীদাহ প্রথা ও নরবলির মত বর্বরোচিত নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ। ভারতবর্ষের এমন কুসংস্কারাচ্ছন্ন কাল্পনিক ধর্মীয় ও সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নজরুল মসী ধারণ করেছিলেন।
মানুষ ধর্মকে নয়, ধর্মই মানুষকে সংস্কার করে। কিন্তু ক্ষমতাধর ও সার্থবাদী মানুষ ধর্মকে ব্যবহার করে অসহায় মানুষের উপর শোষণ জুলুম ও অত্যাচার চালায়। নজরুল লিখলেনÑ ‘কাটায় উঠেছি ধর্ম-আফিম নেশা/ধ্বংস করেছি ধর্ম-যাজকী পেশা,/ভাঙ্গি মন্দির, ভাঙ্গি মসজিদ,/ভাঙ্গিয়া গীর্জা গাহি সঙ্গীত-/এক মানবের এক রক্ত মেশা’। নজরুল তাঁর ‘সাম্যবাদী’ কাব্যের ‘মানুষ’ কবিতায় লিখেছেন-‘আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু,/আমার ক্ষুধার অন্ন তা বলে বন্ধ করোনি প্রভূ/তব মসজিদ-মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী,/মোল্লা পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি’। এটা সৃষ্টিকর্তার প্রতি অসহায় ভূখা-নাঙ্গা মুছাফিরের আকুল আর্তি!
কবি নজরুলের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে মুসলমান ও হিন্দু ধর্মে স্বার্থান্বেষী মহলের চাপিয়ে দেওয়া কুসংস্কার, অসাম্যতা আর অনাচারগুলো সাহসিকতার সাথে তুলে ধরা। তাঁর কবিতার উপজীব্য বিষয় হচ্ছে- ‘মানুষ’। এমন অসাম্প্রদায়িক নজরুল বিশ্বে একজনই। বিশ্বের কোন কবির সাথেই নজরুলের ভাবধারার তুলনা চলেনা । কবি ‘কৃষাণের গান’ কবিতায় লিখেছেন-‘আজ জাগরে কৃষাণ সব ত গেছে, কিসের বা আর ভয়,/এই ক্ষুধার জোরেই করব এবার সুধার জগৎ জয়’। নজরুল তার জীবনের সকল প্রতিকুলতা আর অভাব অনটনকে অতিক্রম করে দীপ্তকন্ঠে উচ্চারণ করেছেন- ‘হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছ মহান,/তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিস্টের সম্মান। কন্টক মুকুট শোভা। -দিয়াছে তাপস,/অসংকোচে প্রকাশের দুরন্ত সাহস,/উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি; বাণী ক্ষুরধার/বাণী মোর শাপে তব হ’ল তরবার।”
ব্রিটিশের দুঃশাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে, ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি, জমিদার ও নীলকরদের অন্যায় অত্যাচার জুলুম শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে নজরুলের আবির্ভাব ছিল ধূমকেতুর মত। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে তিনি লিখলেনÑ“এ দেশ ছড়বি কিনা বল/নইলে কিলের চোটে হাড় করিব জল”। নজরুল নারী-পুরুষের মাঝেও কোন ভেদাভেদ দেখেননি। তাই ‘নারী’ কবিতায় তিনি লিখেছেন- ‘এ বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।/জ্ঞানের লক্ষ¥ী, গানের লক্ষ্মী শস্যলক্ষ্মী নারী/সুষমা-লক্ষ্মী নারীই ফিরিছে, রূপে রূপে সঞ্চারি।” অথবা ‘তাজমহলের পাথর দেখেছ, দেখিয়াছ কি তার প্রাণ?,/ভিতরে তার মমতাজ নারী, বাহিরেতে শাজাহান’। নজরুল শিশুদের নিয়ে লিখলেন-‘ভোর হলো/দোর খোল/খুকুুমণি ওঠরে/ওই ডাকে/জুঁই শাখে/ফুলখুকি ছুটরে’। অথবা ‘আমি হবো সকাল বেলার পাখি/সবার আগে কুসুমবাগে উঠবো আমি ডাকি’। কিংবা ‘থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে,দেখবো এবার জগতটাকে,/কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরে ঘুর্ণিপাকে’।
নজরুল ‘ধূমকেতু’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। ‘সওগাত’ সম্পাদক মোঃ নাসিরউদ্দিন লিখেছেন, নজরুল ইসলাম তাঁর নিজস্ব চিন্তাধারা ও মতবাদ প্রকাশের উদ্দাম ইচ্ছায় নিজেই পত্রিকা বের করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি পত্রিকাটির নাম দেন ‘ধূমকেতু’। নজরুল তাঁর ‘ধূমকেতু’ কবিতায় লিখলেন-“আমি যুগে যুগে আসি/আসিয়াছি পূনঃবিপ্লবহেতু/ঐ স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু”। বাংলা সাহিত্যে নজরুলের এটা একক অবদান। যা তাঁর আগেও কোনদিন ছিলোনা এবং পরেও আর দেখা যায়নি। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় বাণী দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, সরোজিনী, বিরজাসুন্দরী দেবী এবং পরীসুন্দরী ঘোষ। ।
তাঁর ‘ধূমকেতু’ পত্রিকাকে আশীর্বাদ করে রবীন্দ্রনাথ লিখলেনÑ “কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু আয় চলে আয় আয়রে ধূমকেতু। আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন”। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে কমরেড মুজাফফর আহমদের সাথে নজরুলের বন্ধুত্ব ও ঘণিষ্ঠতা হয়। মুজাফফর আহমদ তখন মার্কসীয় দর্শনে ব্যুৎপত্তি লাভ করছিলেন। নজরুলকে তিনি শেষাবধি নানাভাবে সহায়তা করেছেন। উল্লেখ্য, ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ২৫-৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে রচিত নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রথম শ্রোতা ছিলেন কমরেড মোজাফফর আহমদ।
ধূমকেতু পত্রিকার ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২২ সংখ্যায় প্রকাশিত নজরুলের ‘আনন্দময়ীর আগমন’ কবিতাটি ব্রিটিশ শাসকদের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। এই কবিতার কারণে নজরুলের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম রাজদ্রোহের মামলা হয়। ১৯২৩ খিস্টাব্দের ১০ জানুয়ারি মামলার রায়ে নজরুলের এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। তিনি ‘নবযুগ’ ও ‘লাঙ্গল’ নামে আরো দু’টি পত্রিকা প্রকাশ করেন।
নজরুল এক অসাধারণ কবি, এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। উপমহাদেশের সাহিত্য সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে তাঁর ভূমিকা এক ঐতিহাসিক ঘটনা। রবীন্দ্র যুগের পর তিনি বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন যুগ সৃষ্টি করেন। তাঁরই ভাষায়Ñ ‘বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ’। সমগ্র মহাদেশ ছিল পরাধীন। সব ধরণের গোঁড়ামী আর মৌলবাদের‘ কুফলে ভরপুর সেই পরাধীন দেশের মানুষকে তিনি দান করেছেন স্বাধীনতা অর্জনের সাহস, মানবতাবোধের উদারতা, সাম্য-চিন্তার অনুপ্রেরণা। তাই নজরুল নিখেছেনÑ ‘গাহি সাম্যের গান/যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান,/যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-খ্রিশ্চান’।
কবির প্রতি যেভাবে অবহেলা করা হয়েছে, অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয়েছে, মর্মাহত কবি তাই আক্ষেপ করে লিখেছেনÑ“তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিবনা,/কোলাহল করি সারাদিনমান কারো ঘুম ভাঙিবনা/নিশ্চল নিশ্চুপ/আপনার মনে পুড়িব আমি গন্ধ বিধুর ধূপ!” তিনি আরো লিখলেনÑ ‘যেদিন আমি হারিয়ে যাবো/বুঝবে সেদিন বুঝবে/অস্তপারের সন্ধ্যা তারায়/আমার খবর পুছবে/ছবি আমার বুকে বেঁধে/পাগল হয়ে কেঁদে কেঁদে/ফিরবে মরু কানন গিরি/সাগর আকাশ বাতাস চিরি/যেদিন আমায় খুঁজবে/বুঝবে সেদিন বুঝবে!
সাপের খোলসের মতো সাহিত্যেরও খোলস থাকে। প্রত্যেক শতাব্দীতে সাহিত্যের খোলস পরিবর্তিত হয়। অর্থাৎ ‘নতুন ধারার’ আবির্ভাব ঘটে। প্রতি শতাব্দীর ‘তিরিশের দশক’ বাংলা সাহিত্যে তাৎপর্য বা পরিবর্তন বয়ে আনে। ভাষা ছন্দ ও অলঙ্কারের কোন স্থির রূপ নেই, নেই সুনির্দিষ্ট চরিত্র। প্রত্যেক যুগ তার উপযোগী ভাষা তৈরী করে নেয়। টি, এস, এলিয়টের ভাষায় বলা যায়, দ্য গ্রেট পয়েট, ইন রাইটিং হিমসেলফ, রাইটস হিজ টাইম. মানুষের সভ্যতা সংস্কৃতির পরিবর্তন ও বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাষার রূপ ও রীতি পাল্টায়। সামাজিক পরিবর্তন বা রাষ্ট্রবিপ্লব ভাষাকে প্রভাবিত করে। সামাজিক পরিবর্তনের চিহ্ন ভাষায় ফুটে ওঠে সব সময়। মুসলিম শাসন ও ইংরেজ আধিপত্য বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অক্ষয় ছাপ রেখেছে।
বর্তমান বিশ^-সাহিত্যকে নজরুল ‘স্বপন-বিহারী’ ও ‘মাটির দুলাল’ এই দু’টি শ্রেণিতে ভাগ করেছেনÑ মোটামুটি সমাজ ব্যবস্থার আর্থিক কাঠামোকে ভিত্তি করে। তাঁর মতে, দুই দিকেই বড় বড় রথী মহারথী। একদিকে নোগুচি, ইয়েটস, রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতি ড্রিমার্স (স্বপ্নচারী) অপরদিকে গোর্কি, যোহান, বোয়ার, বার্নাড শ, বেনাভাতে প্রমুখ। রুশ সাহিত্যিক গোর্কির প্রতি নজরুল অপরিসীম শ্রদ্ধা পোষণ করতেন।
কবির সাহিত্যকাল ১৯১৯ থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি বাংলা সাহিত্যে একটা নতুন যুগ সৃষ্টি করেছেন। নজরুল তাঁর লেখনীর মাধ্যমে মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি চিন্তা ভাবনার আকর তার কাল ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার রূপ তুলে ধরেন। ‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান’। অসাম্প্রদায়িক নজরুল প্রমীলা দেবীকে বিয়ে করে মানবিকতার পরিচয় দিয়েছেন। বাংলা এবং আরবি/ফারসি ভাষার সংমিশ্রণে তিনি তাঁর চার ছেলের নাম রেখেছেন- কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ (বুলবুল), কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ্। কবির এক পুত্রবধূও ছিলেন হিন্দু। নজরুল গজল আর ইসলামী সংগীতের পাশাপাশি শ্যামা সংগীতও রচনা করেছেন। যা উভয় ধর্মাবলম্বীদের কাছেই সমানভাবে সমাদৃত। কবির গানের সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার। এসব গানের মধ্যে ভক্তিমূলক গান রয়েছে ১২শ’। কাজী নজরুল ইসলামের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৫১টি। প্রিয় পাঠক, নজরুলকে বাংলা সাহিত্য থেকে মুছে ফেলার গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। পাঠাগার গুলোতে নজরুলের বই খোঁজে পাওয়া যায়না। প্রকাশকদেরও নজরুলের বই পুনঃপ্রকাশে অনীহা লক্ষ্য করা যায়। এব্যাপারে নজরুল ভক্তদের জেগে উঠতে হবে। নজরুলের সবগুলো বই পূনঃপ্রকাশের আয়োজন করতে হবে।
নজরুলের গানের ভাবার্থ হৃদয়ের পরতে পরতে অনুরণিত হয়। যেমন- ‘খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশৃ আনমনে খেলিছ’, ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয় সেকি মোর অপরাধ’, ‘আঁচল ভরা ফুলগো তোমার নয়ন ভরা জল’ আমায় নহে গো ভালোবাস শুধু ভালোবাস মোর গান’ ‘কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট’, ‘শিকল পরার ছল মোদের এই শিকল পরার ছল’ এবং ‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই’। নজরুলের এসব গান, হামদ-নাত, গজল আগের মত আর প্রচার করা হয়না। এব্যাপারে সরকার ও নজরুল ভক্তদের দৃষ্টি দেওয়া দরকার।
নজরুলের জীবনের পরতে পরতে শুধু অবহেলা দুঃখ যাতনা আর দারিদ্র্যের নিষ্ঠুরতা তাকে হায়েনার মত খাবলে ছিড়ে ফেড়ে খেতে চেয়েছে। কিন্তু অদম্য নজরুল কোথাও মাথা নত করেননি। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য, বিভিন্ন ধর্ম-গোত্র-বর্ণের মানুষকে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য কবি লিখেছেন, ‘শোনহ মানুষ ভাই/সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় লিখেছেনÑ “মহা-বিদ্রোহী রণক্লান্ত/আমি সেইদিন হব শান্ত/যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবেনা,/অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবেনা/বিদ্রোহী রণক্লান্ত/আমি সেইদিন হব শান্ত/” সন্ধ্যা কাব্যে আশাবাদী কবি ঘোষণা করলেন ‘ওরে ও ভোরের পাখি।/আমি চলিলাম তোদের কন্ঠে আমার কন্ঠ রাখি।/তোদের কিশোর তরুণ গলার সতেজ দৃপ্ত সুরে/বাঁধিলাম বীণা নিলাম সে সুর আমার কন্ঠে পুরে’।
নিষ্ঠুর নিয়তির কী নির্মম পরিহাস (!) ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ৪৩ বছর বয়েসে এই মহান বিপ্লবী কবি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। রহস্যজনক দুরারোগ্য ব্যাধিতে তিনি ৩৪ বছরকাল বাকরুদ্ধ ছিলেন। কবির লেখনীশক্তি আজীবনের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়! বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খ্যাতনামা চিকিৎকরা এই জটিল ব্যাধির চিকিৎসা করে ব্যর্থ হন। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কাজী নজরুল ইসলামকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। কবিকে নাগরিকত্ব প্রদানসহ স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট কাজী নজরুল ইসলাম ৭৭ বছর বয়েসে ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে কোলকাতা বিশ^বিদ্যালয় কবিকে “জগত্তারিণী” পদক প্রদান করে। ভারত সরকার কবিকে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে “পদ্মভূষণ” খেতাবে ভূষিত করে। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় কবিকে ডি. লিট উপাধি প্রদান করে এবং ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে কবিকে একুশে পদক প্রদান করা হয়। অসহায় নির্বাক বোধশক্তিহীন কবি তাঁর অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য এতসব গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি, পুরস্কার ও অবদানের স্বাদ উপভোগ করতে পারেননি।
১৩ নভেম্বর ২০২১ সৈকত সাহিত্য সংসদ ও গাঙচিল আন্তর্জাতিক সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদ কর্তৃক আয়োজিত জামালপুরের মেলান্দহে অনুষ্ঠিত কবি ও লেখক সমাবেশে তালাত মাহমুদ তাঁর ‘সম্প্রীতির কবি নজরুল’ প্রবন্ধটি উপস্থাপন করেন।
—————
লেখক পরিচিতি: বিগত শতাব্দীর আশির দশকের আলোড়নসৃষ্টিকারী কবি সাংবাদিক ও কলামিস্ট তালাত মাহমুদ ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ আগস্ট অবিভক্ত ময়মনসিংহ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন।। প্রচণ্ড সাংগঠনিক কর্মক্ষমতার অধিকারী ও ক্ষুরধার লেখনীর আপোসহীন কলমসৈনিক তালাত মাহমুদ ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাশ করার পর একইসাথে এলএলবি ও ময়মনসিংহ আনন্দমোহন বিশ^বিদ্যালয় কলেজে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে অধ্যয়ন করেন। তিনি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সাথে ওঁৎপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তাঁর পিতা মনিরুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধের একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তালাত মাহমুদ জাতীয় লেখক কবি শিল্পী সংগঠন “লেকশি” এবং “কবি সংঘ বাংলাদেশ”-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তিনি ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় সাড়াজাগানো “জিলবাংলা সাহিত্য পুরস্কার” লাভ করেন। কবির প্রথম গ্রন্থ “স্বর্গের দ্বারে মর্তের চিঠি” ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয়। নীলকন্ঠ কবি তালাত মাহমুদ দৈনিক দেশবাংলা, সাপ্তাহিক জনকন্ঠ, দৈনিক ঢাকা রিপোর্ট, সাপ্তাহিক পূর্বকথা সহ বিভিন্ন পত্রিকায় গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া ইত্তেফাক, ইনকিলাব, জাহান, কালের ডাক, পল্লীকন্ঠ প্রতিদিন, ভোরের আলো, শ্যামলবাংলা২৪ডটকম সহ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় কবির অসংখ্য লেখা প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাউল সমালোচক সংঘ ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের ১৮ নভেম্বর কবিকে প্রথম সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে। পরবর্তীতে বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান কবিকে সংবর্ধনা প্রদান করে। তাঁর সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকা ‘সাহিত্য দর্পণ’ (১৯৭৩-১৯৮৬) ও ‘আমরা তোমারই সন্তান’ (১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রকাশিত হয়ে আসছে।)#